নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
নারায়ণগঞ্জে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। প্রতি বছরই এখানে আগুনে পুড়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ, ঝরে পড়ছে প্রাণ। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত জেলায় মোট ৪৮৯টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এসব ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ১৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকার, আর ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতায় উদ্ধার করা গেছে ৩০৪ কোটি টাকার সম্পদ। নিহত হয়েছেন ১৭ জন।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ আল আরেফীন বলেন, “শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জের অধিকাংশ শিল্পকারখানা, বাণিজ্যিক ভবন, সুপারমার্কেট ও বহুতল আবাসিক ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা নেই। আইন অনুযায়ী প্রতিটি ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা, হাইড্রেন্ট সিস্টেম ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী থাকা বাধ্যতামূলক হলেও বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না।”
নারায়ণগঞ্জ মহানগরের নয়ামাটি, টানবাজার, নিতাইগঞ্জ ও উকিলপাড়া এলাকায় অবস্থিত অসংখ্য কেমিক্যাল গোডাউনে অগ্নিনিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই। জেলা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব এলাকার ঘিঞ্জি গলি ও পুরোনো ভবন অগ্নিনির্বাপণ কাজে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় দোকানদার শওকত আলী বলেন, “গলিগুলো এত সরু যে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতেই পারে না। আগুন লাগলে আমরা সবাই মিলে বালতি দিয়ে পানি ঢালি—এটাই আমাদের ব্যবস্থা।”
ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী—জানুয়ারিতে ৮৯টি অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতি ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা, উদ্ধার ২৬৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা,মার্চে ৫৭টি অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতি ৫৫ লাখ টাকা, উদ্ধার ৫ কোটি ২০ লাখ টাকা,এপ্রিলে ৭৬টি ঘটনায় ক্ষতি ৬ কোটি ২ লাখ, উদ্ধার ১৯ কোটি ৭০ লাখ,মে মাসে ৬২টি ঘটনায় ক্ষতি ৬৬ লাখ, উদ্ধার ৩ কোটি ১৪ লাখ,জুনে ৫০টি ঘটনায় ক্ষতি ১ কোটি ২ লাখ, উদ্ধার ৮ কোটি ১১ লাখ,
জুলাইয়ে ৩৮টি ঘটনায় ক্ষতি ৪৬ লাখ, উদ্ধার ২ কোটি ১৭ লাখ,আগস্টে ৪২টি ঘটনায় ক্ষতি ২৫ লাখ, উদ্ধার ৬ কোটি ২১ লাখ,সেপ্টেম্বরে ৫০টি ঘটনায় ক্ষতি ৭৮ লাখ, উদ্ধার ২ কোটি ৬১ লাখ,অক্টোবরের ২০ তারিখ পর্যন্ত ২৫টি ঘটনায় ক্ষতি ৩৪ লাখ, উদ্ধার ১ কোটি টাকা।
ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার বেশিরভাগ গার্মেন্টস, ডাইং ও প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নামমাত্র। একাধিক শ্রমিক অভিযোগ করে বলেন, “আমাদের ফায়ার এক্সটিংগুইশারগুলো পুরানো। তিন বছর আগে একবার ট্রেনিং হয়েছিল, এরপর আর কিছু হয়নি। অনেক জায়গায় জরুরি দরজায় তালা ঝুলানো থাকে।”
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বলেন, “আমরা বারবার নোটিশ দিয়েছি, অভিযানও চালিয়েছি। কিন্তু এসব গোডাউন সরানো যায়নি। ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় প্রশাসনিক পদক্ষেপ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এখন নতুন নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে কেমিক্যাল ব্যবসাগুলোকে নির্দিষ্ট অঞ্চলে স্থানান্তর করা যায়।”
ফায়ার সার্ভিসের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়—২০২০ সালে অগ্নিকাণ্ড হয়েছিল ৩৪৭টি,২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫৯টি,আর ২০২৫ সালের মাত্র ১০ মাসেই সংখ্যা পৌঁছেছে ৪৮৯-এ।
Leave a Reply